বিজয়ের সূর্য
মা, তুমি কাঁদো কেন? তোমার মেয়ে যুদ্ধে যাইবো তুমি খুশি না?
একটু শক্ত কন্ঠে রানু তার মাকে জিজ্ঞেস করলো। মা রেহেনা বেগম অশ্রুসিক্ত চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন। তার একটা মাত্র মেয়ে। কি করে মেয়েকে বিপদের মুখে ঠেলে দিবেন তিনি। তবে তার মেয়ে যে আজ তার কথা মানবে না। মায়ের কোনো উত্তর না মেয়ে রানু বলল,”তুমি যেমন আমার মা, তেমনই এই দেশটাও আমার আরেক মা। আমি আমার মায়ের বিপদ রাইখা ঘরে বইসা থাকি কেমনে বলোতো? তুমি তো আমার আত্মার অংশ। এই দেশটা যে আরেক অংশ মা।”
বিশ বছরের তরুণী রানু খুবই দৃঢ় কন্ঠে কথাগুলো তার মা কে বললো। রানু ঢাকা থেকে পড়াশোনা করছে। শেষবারের মতো গ্রামে মায়ের সাথে দেখা করতে এসেছে। এখান থেকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য যাবে। তারপর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করবে। রানুর বাবা মারা গেছেন কয়েকবছর আগে। মায়ের স্বপ্ন রানু অনেক বড় হবে। তাই ঢাকা তার মামার বাড়ি পাঠিয়ে দেন পড়াশোনার জন্য। রানু ছাড়া রেহেনার আর কেউ নেই। কিন্তু এই দেশটাকে যে হায়নারা শেষ করে দিচ্ছে। হাজারো মানুষের জীবন এক লহমায় কেড়ে নিচ্ছে পাকবাহিনী। রানু এসব দেখে কীভাবে বসে থাকবে। তার দায়িত্ব এই দেশটাকে রক্ষা করা। এসব ভেবে মনকে শক্ত করে রানু বলল,”মা,ভাতটা খাওয়ায় দেওতো। আমার আবার তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে”।
চোখের পানি মুছে রেহেনা বেগম তার সাত রাজার ধনের মাথায় হাত বুলিয়ে খাবার খাইয়ে দিলেন। এখন তার গর্ব হচ্ছে এমন একটা মেয়ে পেটে ধরে।রানু তার মায়ের কোলে মাথা রাখলো। আর কখনো রাখতে পারবে কিনা সে জানেনা। এখন যে তার অনিশ্চিত জীবন। মা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। বাইরে প্রবল বৃষ্টি। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ হচ্ছে। রানুকে এবার যেতে হবে। তার আরেক মা যে তার অপেক্ষায়। এই বৃষ্টির মধ্যেই মায়ের দোয়া নিয়ে রানু বেরিয়ে গেল তার দেশ মাকে রক্ষা করতে।রেহেনা বেগম তাকিয়ে রইলেন। এক সময় শূন্যে মিলিয়ে গেল তার কলিজার টুকরা।
এভাবেই কেটে গেল সময়। বাংলার আকাশে বিজয়ের সূ্র্য উঠেছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। যারা যারা যুদ্ধে গিয়েছিল সবাই ফিরে এসেছে। রেহেনা বেগম পথ চেয়ে আছেন তার রানু আসে না কেনো?এই তো একটু আগে দেশ স্বাধীন হলো। লাল সবুজের পতাকা উড়ছে সর্বত্র। এমন সময় দুইটা তরুণ আসলো রেহেনা বেগমের সাথে দেখা করতে। তাদের সাথে কথা বলে রেহেনা পাগলামি শুরু করেছেন। “কি বলছো তোমরা এসব? আমার রানুর কিছু হয়নি।রানু রানু মা কই তুই মা। মায়ের বুকে আয়। মার বুকটা যে ফাইট্টা যাইতাছে।”
রেহেনা বেগম কান্না করতে করতে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। পাশের বাড়ির করিম মিয়া ও তার মেয়ে ছুটে এসেছে চেঁচামেচি শুনে। তরুণরা করিম মিয়াকে বলল রানু নামের এক মেয়ে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে শহীদ হয়েছে। তার লাশ পাওয়া যায়নি। এই খবরটা তারা পৌঁছে দিতে এসেছে। করিম মিয়া স্তব্ধ হয়ে কথাগুলো শুনলেন। তার কিছু বলার নাই। রেহেনা বেগম যে পাগল হয়ে যাবেন। তরুণ দুটি একটা রক্তাক্ত চিঠি করিম মিয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল।রেহেনা বেগমকে খাটে শুইয়ে রাখা হয়েছে। তার এখনো জ্ঞান ফিরেনি।
করিম মিয়া চিঠি টা খুলে পড়া শুরু করলেন,
মা,
কেমন আছো তুমি? আমার যে তোমাকে ছাড়া ভালো লাগেনা। কতদিন তোমায় দেখিনা। আজ একটা মিশনে গেছিলাম। তোমার মেয়ে এখন অনেক সাহসী। যেই মেয়ে রক্ত দেখতে পারতো না সে এখন রক্তাক্ত করে দেয় পশুদের। জানো মা আমার না অনেক ক্ষুধা লাগছে। দুইদিন ধরে কিছু খাই নাই।আমি বিজয়ীর বেশে যখন আসবো তোমার কাছে তুমি আমাকে খাওয়াবা না পেট ভরে?আমি কিন্তু তোমার হাতে খাবো।
এই তুমি কাদঁছো কেন? আমার কষ্ট লাগে না। তোমার মেয়ে যে দেশ মায়ের জন্য যুদ্ধে নামছে। আমি ফিরে না আসলেও তুমি হইবা শহিদ জননী।
মা, লেখা গুলো যারে দিয়া পড়াইতেছো তার বোধহয় পড়তে কষ্ট হচ্ছে। লেখাগুলো বা হাতে লিখছি। আমার ডান হাতটা যে আর নেই মা।….
করিম মিয়ার দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো জল। আজ দেশে বিজয়ের রক্তিম সূর্য উঠেছে।এই সূর্য উঠার পিছনে কত মায়ের,বোনের ত্যাগ রয়েছে। রেহেনা বেগমের মতো কত মা তার সাত রাজার ধন হারিয়েছেন। এই বিজয়ের জন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছে বাঙালিকে। এই বিজয় ত্যাগের। এই বিজয় বহু শহীদের রক্তে কিনা অমূল্য ধন। যতবার এই বিজয় দিবস আসবে ততবার বাঙালি স্মরণ করবে রানুদের মত বীরদের।
Visit our Instagram and Facebook.
Follow The Interlude for more.
Bol