রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট চলাকালীন সময়ে যেহেতু মার্কিন ডলার সবচেয়ে শক্তিশালী মুদ্রার স্থান দখল করেছে, তার ফলে বাংলাদেশি টাকার মূল্য সাম্প্রতিক মাসগুলোতে উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
কোভিড-১৯ মহামারী বহু দিক থেকে সারা বিশ্বের জন্য হুমকি স্বরূপ দেখা দিয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে অর্থনৈতিক বিপর্যয়। অস্থিতিশীল মুদ্রাবাজার এমনিতেই ছিল আমাদের অর্থনীতির জন্য বড় দুর্দশার কারণ, সেই সাথে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্ব সেসব সমস্যা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
২০২১ সালের চতুর্থ ত্রৈমাসিক থেকেই গ্রিনব্যাকের বিপরীতে বাংলাদেশের এক্সচেঞ্জ রেট চাপের মধ্যে আছে। কারণ মহামারী পরিস্থিতির উন্নতির সাথে সাথে আমদানির পরিমাণ উপচে পড়ে বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে ।
২০২১ সালের শেষ নাগাদ, বিশ্বের অর্থনীতিগুলো তখন সবেমাত্র মহামারীর ক্ষতি কাটিয়ে উঠছে। এরইমধ্যে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ ছিল আরেকটি উল্লেখযোগ্য আঘাত। যেহেতু এই দুই দেশ বিশ্বের অন্যতম প্রধান জ্বালানী তেল, ধাতু এবং কৃষিপণ্য রপ্তানিকারক, তাদের মধ্যকার যুদ্ধে আবারও বিশ্বব্যাপী সরবরাহ ব্যাহত হওয়াই স্বাভাবিক। আর এই খাতগুলোতে সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার ফলে বিশ্বের সব দেশেই জ্বালানী এবং নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম বেড়েছে। ২০২২ সালের মার্চ মাসে মার্কিন মুদ্রাস্ফীতির হার ৮.৫ শতাংশ ছুঁয়েছে, যা ১৯৮১ সালের পর দেশটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এই মুদ্রাস্ফীতি সামাল দিতে মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ তার মূল সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছে।
সাধারণত, উচ্চ সুদের হার ঋণের সামগ্রিক মূল্য বাড়িয়ে দেয়, ফলে তা মানুষের সাধা্রণ খরচের প্রবণতা কমিয়ে আনাতে প্রভাব রাখে। চাহিদার কমতি কমিয়ে যায় ক্রমবর্ধমান মূল্য বা মুদ্রাস্ফীতি। এছাড়াও, উচ্চ সুদের হার বিদেশী বিনিয়োগ উৎসাহিত করে এবং স্থানীয় মুদ্রার চাহিদা বাড়ায়। এভাবেই মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ডলারের চাহিদা এবং মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে। অন্য কথায়, ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে এর বিপরীতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মুদ্রার মূল্য হ্রাস পাচ্ছে।
৯ জানুয়ারী ২০২২ তারিখে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য ২৫% কমে গিয়ে গত ১৩ বছরে সর্বনিম্ন ৮৬.০০ টাকায় ঠেকে। এদিকে, বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং কার্ব বা খোলা বাজারে (ডলার লেনদেনের অবৈধ প্ল্যাটফর্ম) ডলার ৯০.০০ টাকার উপরে বিক্রি হয়েছে। একটি কার্যদিবসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্থানীয় মুদ্রার মান ডলারপ্রতি প্রায় ০.০৫ টাকা থেকে ০.১০ টাকা হ্রাস করে। কিন্তু এবার আগের কার্যদিবসে আন্তঃব্যাংক এক্সচেঞ্জ রেট ছিল ৮৫.৮০ টাকা, অর্থাৎ ০.২০ টাকা কমেছে। সেই হিসেবে এই মূল্যহ্রাস ছিল বেশ বড়সড়।
মুদ্রাস্ফীতি একটি দেশের পণ্যকে বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে নিয়ে যায়, যা রপ্তানি বাড়াতে সাহায্য করে। তাই বলা যায়, এই মূল্যহ্রাস হচ্ছে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের দৃষ্টিভঙ্গি, অপরদিকে আমদানি বৃদ্ধি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ হ্রাসের কারণে স্থানীয় মুদ্রার উপর চাপের ফলাফল।
টাকার আরো মূল্যহ্রাস; একটি স্থিতিহীন মুদ্রাবাজার
১৭ মে ২০২২ তারিখে ডলারের দাম আরেক দফা বেড়ে ৮৭ টাকার বেশি হয়, জুনের শুরুতে তা ৯১ টাকা ছাড়িয়ে যায়। বর্তমানে, ২০২২ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে ডলারের দাম দাঁড়িয়েছে ১০২.১৫ বাংলাদেশী টাকায়।
নির্ধারিত দর থাকার পরও, ডলারের ঘাটতির কারণে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে ডলারের দামে ৫-৬ টাকার পার্থক্য ছিল। উচ্চ আমদানি মূল্য, রেমিট্যান্স কমে যাওয়া এবং এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নকে (এসিইউ) এ বছরের শুরুতে মোটা অঙ্কের অর্থ প্রদানের ফলে ডলারের সরবরাহ সীমিত হয়ে যায় এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে, যা গত বছর ছিল ৪৭ বিলিয়ন ডলার। .
কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে ডলারের মূল্যের ব্যবধানের অর্থ হল টাকার ক্রমাগত অবমূল্যায়ন শুরু হয়েছে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া এক্সচেঞ্জ রেট অকার্যকর হয়ে পড়ছে। এই সংকটময় পরিস্থিতি বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতির পাশাপাশি টাকার তীব্র মূল্যহ্রাসকে ত্বরান্বিত করেছে।
মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার লাগাতার অবমূল্যায়নের পর, স্থানীয় কার্ব মার্কেটে ডলারের দামও বেড়েছে। ১০ আগস্ট ২০২২ তারিখে প্রতি ডলারের মূল্য সর্বোচ্চ ১১৯ টাকায় পৌঁছেছে, যার কারণ ডলারের সরবরাহ ঘাটতি। ভবিষ্যতে ডলারের দাম আরো বাড়বে, এই আশায় কেউ কেউ ডলার মজুদ করে রেখেছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। ফলে ডলারের দামের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহীত পদক্ষেপ অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।
ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেমে ফরেক্স মার্কেট চাহিদা এবং সরবরাহের উপর ভিত্তি করে অন্যান্য মুদ্রার বিপরীতে একটি দেশের মুদ্রার মূল্য নির্ধারণ করে। অন্যদিকে, ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট প্রাথমিক বা পুরোপুরিভাবে সে দেশের সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হয়।
১৩ সেপ্টেম্বর উচ্চমূল্য এবং পণ্যের উচ্চ চাহিদার কারণে স্ফীত আমদানি বিল এবং তার ফলস্বরূপ ক্ষয়িষ্ণু বৈদেশিক রিজার্ভ রক্ষা করতে ডলারের বিপরীতে একটি ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট কার্যকর করা হয়েছিল। একই দিনে, আন্তঃব্যাংক এক্সচেঞ্জ রেট আগের দিনের চেয়ে বেড়ে ৯৭ টাকা থেকে ১০৭.১৫ টাকা (সর্বোচ্চ) এবং ১০১.৭৭ টাকা (সর্বনিম্ন) হয়। ফলে টাকার মান ১১.৭৩% কমে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি করে। এভাবে গত এক বছরে মার্কিন ডলারের বিপরীতে ২৫% কমেছে টাকার মূল্য।
ব্যাংকগুলো বর্তমানে ফরেন এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে রেমিট্যান্স হিসাবে সর্বোচ্চ ১০৭.৫ টাকা মূল্যে ডলার ক্রয় করে, অপরদিকে রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে ডলারের ক্রয়মূল্য সর্বোচ্চ ৯৯ টাকা।
আমদানিকারকরা এখন অতিরিক্ত বেশি এক্সচেঞ্জ রেটে ডলারের জন্য অর্থ প্রদান করছেন, যা গড়। যে মূল্যে ব্যাংকগুলো রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে ডলার অর্জন করে এবং বৈদেশিক মুদ্রা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে রেমিটেন্স সংগ্রহ করে এবং অতিরিক্ত ১ টাকা।
বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (BAFEDA) বর্তমানে আন্তঃব্যাংক এক্সচেঞ্জ রেট নির্ধারণ করছে ব্যাংকগুলোর বেচাকেনার হারের ভিত্তিতে। ব্যাংক বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন যে ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল করতে সহায়তা করবে। যদিও BAFEDA এবং অ্যাসোসিয়েশন অফ ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (ABB) আমদানি, রপ্তানি এবং রেমিট্যান্সসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডলারের একাধিক হার নির্ধারণ করেছে, কিন্তু একাধিক হার মুদ্রাবাজারের অস্থিরতা আরো বাড়িয়ে দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশের ফরেক্স রিজার্ভ দ্রুত হ্রাসের পিছনে প্রাথমিক কারণ হল আমদানি ব্যয়ের আধিক্য। এই বছরের ১২ অক্টোবর পর্যন্ত, ফরেক্স রিজার্ভ ৩৭.৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। অথচ দুই সপ্তাহ আগে ২৯ সেপ্টেম্বরেও রিজার্ভ ছিল ৩৭.৫ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত ৪.১৫ বিলিয়ন ডলার ইনজেকশন দিয়েছে, যাতে ঋণদাতাদের আমদানি বিল নিষ্পত্তি করতে সক্ষম হয়। এটি দেশের দ্রুত ক্ষয়িষ্ণু বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করেছে।
এরাবিয়ানপোস্টের একটি আর্টিকেল টাকার সাম্প্রতিক মূল্যহ্রাস নিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ এবং বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগের কারণ ব্যাখ্যা করেছে। অর্থনীতিবিদদের উদ্বেগের বিষয় হল, মার্কিন ডলারের চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধির ফলে এক্সচেঞ্জ রেটে টাকার মান কমেছে ঠিকই, কিন্তু সেই সাথে আশানুরূপ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়নি দেশের রপ্তানি আয়। স্থানীয় ব্যাংকগুলো প্রতি মার্কিন ডলারে অতিরিক্ত ৫ থেকে ৮ টাকা প্রদান করছে, যা অনেক ক্ষেত্রে তাদের ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে।
গ্রাহক পর্যায়ে আমদানি বিল পরিশোধের পাশাপাশি, ইউক্রেন সংকটের পর বিশ্বব্যাপী দ্রব্যমূল্যের অস্থিরতা মার্কিন ডলারের ক্রমবর্ধমান চাহিদাকে উস্কে দিয়েছিল। যেহেতু গমের ৩০-৩৫% আমদানি করা হয় রাশিয়া এবং ইউক্রেন থেকে, সেহেতু আশঙ্কা রয়েছে যে, বাংলাদেশে গমের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে।
কমে যাওয়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং মার্কিন ডলারের ঘাটতি বাংলাদেশের জন্য তেল আমদানি আরো কঠিন করে তুলেছে। কারণ নিয়মিত লেনদেনে প্রশাসনিক বিলম্ব কখনো কখনো এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চলে। এই বিলম্ব কমিয়ে আমদানি রপ্তানি যথাসম্ভব সময়মতো সম্পন্ন করতে ব্যাংকগুলোকে বাজারের দামে মার্কিন ডলার কেনার অনুমতি দেয়া হয়। যদিও বর্ধিত দামে ডলার ক্রয় ডলারের অবক্ষয় এড়াতে সাহায্য করছে, কিন্তু দেশকে এর মূল্য চুকাতে হচ্ছে আভ্যন্তরীণ বিশালাকার মুদ্রাস্ফীতির মাধ্যমে।
সাধারণ জনগণ, যারা এখনও তাদের আয়ের উপর থেকে মহামারীর ধাক্কা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি, তাদের বর্তমান ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনা করে বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে সত্যিকারের পরিস্থিতি আরও খারাপ। উপরন্তু টাকার মূল্যহ্রাস আভ্যন্তরীণ বাজার পরিবর্তনে বিরাট ভূমিকা রাখে। এর দ্বারা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম দ্রুত বৃদ্ধি পায়, নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রভাবিত হয়।
বর্তমান সরকারের সামনে এখন কঠিন চ্যালেঞ্জ। যখন দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য হচ্ছে পর্যাপ্ত এবং টেকসই ফরেক্স রিজার্ভ সুরক্ষা নিশ্চিত করা, তখন বাজার ব্যবস্থাপনা এবং ডলার-টাকা এক্সচেঞ্জ রেটের পরিবর্তন একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার আশু সমাধান অত্যাবশ্যক। অদূর ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাজারে পরিবর্তনের আলোকে বাংলাদেশের মূল অর্থনীতিতে সংস্কারের প্রয়োজন হতে পারে।
Navigating the IELTS listening section can be a daunting task, especially for those with short…
Writing, especially during exams, can be daunting. Despite considering myself a proficient writer, tackling the…
I have an overall 8.5 score with a ✨9✨ in Reading (makes me giggle for…
Last year, I embarked on my IELTS journey with minimal preparation, courtesy of a jam-packed…
I've been seeing people say they don't understand what's going on with Israel and Palestine…
The death toll in Gaza and the Occupied West Bank on the 31st December 2023…