ই-সিম: সিম কার্ডের আগামী বিশ্ব স্ট্যান্ডার্ড
সম্প্রতি একটি নতুন বৈশিষ্ট্যযুক্ত বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাগশিপ ফোন বের হয়েছে। সেটি হল ই-সিম ৷ ফোন নির্মাতাদের পাশাপাশি টেলিকম সার্ভিস প্রদানকারীরাও তাদের ই-সিম সক্ষমতার বিজ্ঞাপনের পেছনে অর্থ ব্যয় করছে। অ্যাপল ব্যাপারটি আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে আইফোন ১৪ প্রো বাজারে এনে, যেখানে তারা সিম-ট্রে সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে ফেলেছে এবং এই ফোনের ইউএস (যুক্তরাষ্ট্র) ভার্শনে ই-সিম কে একমাত্র উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছে।
কিন্তু এই ই-সিম বলতে কী বুঝায় এবং কেন এটি সম্পর্কে আমাদের জানা দরকার?
প্রথমত আমাদের জানতে হবে,
সিম কি?
সিম (SIM) শব্দটি হলো সাবস্ক্রাইবার আইডেন্টিফিকেশন মডিউলের সংক্ষিপ্ত রূপ।
সিম কার্ড হচ্ছে অপসারণযোগ্য প্লাস্টিক কার্ডে ছাপানো ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট, যা ফোনে ম্যানুয়ালি প্রবেশ করানো যায়, যা আলাদা আলাদা ব্যবহারকারীকে সনাক্ত করতে, সেইসাথে পরিচিতি ও ক্ষুদেবার্তার মতো তথ্য সংরক্ষণ করতে ব্যবহৃত হয়।
সিম কত প্রকার?
১৯৯১ সালে সিম প্রযুক্তি আবিষ্কারের পর থেকে এখন পর্যন্ত এ খাতে বড় ধরনের উন্নতি হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে ফোনগুলো যেমন কমপ্যাক্ট হয়েছে, সিম কার্ডের আকারও ছোট হয়ে গেছে।
- ১৯৯১ সালে পূর্ণ আকারের স্ট্যান্ডার্ড সিম কার্ড (৮৫ মিমি x ৫৩ মিমি) চালু করা হয়েছিল
- ১৯৯৬ সালে বাজারজাত করা হয়েছিল মিনি সিম (২৫ মিমি x ১৫ মিমি) এবং এটি তখন স্ট্যান্ডার্ড হয়ে উঠেছিল
- মাইক্রো-সিম (১৫মিমি x ১২মিমি) ২০০৩ সালে আত্মপ্রকাশ করেছিল
- ন্যানো-সিম (১২.৩মিমি x ৮.৮মিমি) চালু হয়েছিল ২০১২ সালে
- ই-সিম চিপ (৬মিমি x ৫মিমি) ২০১৬ সালে যাত্রা শুরু করেছে
ই-সিম কী?
ই-সিম (এমবেডেড-সিম) হল কয়েক দশক পুরনো সিম প্রযুক্তির সর্বশেষ রূপ, যা পূর্ববর্তী বেশ কয়েকটি সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে।
ই-সিম একটি প্রোগ্রামেবল সিম কার্ড যা সরাসরি ডিভাইসে এমবেড করা হয়। একটি রিমুভেবল প্লাস্টিক কার্ডে (যা UICC কার্ড নামেও পরিচিত) সিম সার্কিট সংযুক্ত করার পরিবর্তে, ডিভাইসের সাথে একটি eUICC চিপ সংযুক্ত থাকে এবং সেই eUICC চিপে ই-সিম এর সফ্টওয়্যার ইনস্টল করা থাকে।
গ্রাহক প্রান্তে, ব্যবহারকারীগণ চিপ থেকে শুধুমাত্র অপারেটর যোগ করতে বা রিমুভ করতে পারেন, কিন্তু যেহেতু চিপটি সার্কিটে স্থায়ীভাবে মাউন্ট করা থাকে, তাই ই-সিম রিমুভ করা সম্ভব নয়।
ই-সিম-এর বিশেষ সুবিধা
পরিবর্তনযোগ্যতা
ই-সিম দিয়ে মোবাইল নেটওয়ার্ক পাল্টানো অনেক সহজ। আপনি একটি ফোন কলের মাধ্যমে, একটি QR কোড স্ক্যান করে, এমনকি একটি অ্যাপ ব্যবহার করে সহজেই আপনার নেটওয়ার্ক পরিবর্তন করতে পারেন৷
ই-সিম ব্যবহারকারীদের বাইরে গিয়ে সিম কার্ড কেনা বা ডেলিভারির জন্য অপেক্ষা করার ঝামেলা পোহাতে হয় না। এ ছাড়াও প্রতিবার সিম পরিবর্তন করার জন্য সিম ইজেক্টর টুলের প্রয়োজন পড়ে না। তাই ওসব ছোট চিপস সামলানোর ঝামেলাও দূর হয়।
একাধিক নম্বরের মালিকানা
ই-সিমগুলোতে একসাথে ৫টি ভার্চুয়াল নম্বর ব্যবহার করা যায়, যার মানে হচ্ছে আপনি ভাল কানেকশন বা ডেটা প্ল্যানের জন্য নেটওয়ার্ক দ্রুত পরিবর্তন করতে পারবেন৷
এটি বিদেশে থাকাকালীন সময়ে রোমিং প্যাকেজ কেনার পরিবর্তে ট্রাভেল সিমগুলোতে স্যুইচ করা আরও সহজ করে তোলে৷
ফোনের ভেতরের স্থান সংকুলান
বর্তমান সিম কার্ডগুলো ইতোমধ্যেই খুব ছোট (৮.৮ মিমি), তবুও কার্ডের স্লট/ট্রেগুলো এখনও ফোনের ভিতরের মূল্যবান স্থান অনেকাংশে দখল করে রাখে। যে স্থানটুকু একটি বড় ব্যাটারি অথবা একটি অতিরিক্ত ক্যামেরা মডিউলের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
এটি স্মার্টওয়াচের মতো অন্যান্য ছোট গ্যাজেটগুলোকে সিম ব্যবহারে সক্ষম করতে পারে। সর্বশেষ স্যামসাং গিয়ার স্মার্টওয়াচের পাশাপাশি সর্বশেষ অ্যাপল ওয়াচগুলো ইতোমধ্যে ই-সিম সাপোর্ট করে এবং অন্যান্য কোম্পানিগুলোকেও তাদের আইওটি (IOT) ডিভাইসগুলোর জন্য এই সুযোগ উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
ফোনের নিরাপত্তা জোরদার
যেহেতু ই-সিমগুলো ফোন থেকে রিমুভ করা যায় না, তাই সেগুলো ফোন চুরি করা এবং বিক্রি করা আরও কঠিন করে ফোনের সুরক্ষা উন্নত করবে৷
ই-সিম এর অসুবিধা:
অনুপলব্ধতা
বর্তমানে ই-সিম বেশিরভাগ ফ্ল্যাগশিপ ফোনগুলোতে পাওয়া যায়। কিন্তু, ই-সিম প্রযুক্তিটির প্রয়োগ ধীরগতির হওয়ায় এমনও হতে পারে যে, কোন ফ্ল্যাগশিপ ফোন থেকে অস্থায়ী ফোনে পরিবর্তন করার সময় সেই ডিভাইসে ই-সিম এর সুবিধা না-ও থাকতে পারে৷
গোপনীয়তায় শঙ্কা
সাধারণ সিম কার্ডে আপনি সহজেই ফোন বন্ধ করে আপনার সিম কার্ডটি বের করতে পারবেন, অন্যদিকে ই-সিমের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়।
ডিভাইস পরিবর্তনে বিঘ্ন ঘটা
আপনার ফোনের ব্যাটারি শেষ হলে, সাধারণ সিম কার্ডের ক্ষেত্রে আপনি শুধুমাত্র সিমটি বের করে তা অন্য ফোনে ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু ই-সিমের ক্ষেত্রে এটি সহজ নয়।
ই-সিম কি সিম প্রযুক্তির শীর্ষে?
না, যদিও ই-সিম হলো সিম কার্ডের সাম্প্রতিকতম বাণিজ্যিক সংস্করণ, কোয়ালকম এবং অন্যান্য বেশ কয়েকটি কোম্পানি ইতিমধ্যেই আই-সিম নিয়ে কাজ শুরু করেছে৷
ই-সিম এবং আই-সিম এর পার্থক্য কী?
ই-সিম ফোনের সার্কিটে এমবেড করা হয়, অন্যদিকে আই-সিম মেইন প্রসেসরে ইন্টিগ্রেট করা হয়।
কিছু বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQs)
একটি ফোনে কতগুলি ই-সিম ব্যবহার করা যেতে পারে?
আপনি আপনার ফোনে একাধিক ই-সিম রাখতে পারেন, কিন্তু আপনি একবারে একটিই ব্যবহার করতে পারবেন।
আমি কীভাবে আমার আইফোন থেকে ই-সিম রিমুভ করতে পারি?
সেটিংসে যান > সেলুলার বা মোবাইল ডেটাতে ট্যাপ করুন > আপনি যে প্ল্যানটি রিমুভ করতে চান সেটিতে ট্যাপ করুন > রিমুভ সেলুলার প্ল্যান -এ ট্যাপ করুন।
আমি কি দুটি ফোনে ই-সিম ইনস্টল করতে পারি?
না, একাধিক ডিভাইসে একই ই-সিম ইনস্টল করা সম্ভব নয়। একটি ই-সিম শুধুমাত্র একটি ডিভাইসে ইনস্টল করা যেতে পারে।
আপনি ই-সিম ডিলিট করে দিলে কী হবে?
আপনি আপনার ই-সিম ডিলিট করে দিলে, আপনি আপনার ক্যারিয়ারের বা মোবাইল অপারেটরের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন এবং তারা আপনাকে এটি পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করবে।
ই-সিম-এর সক্ষমতাসহ কিছু ফোন
যেহেতু ই-সিম একটি অপেক্ষাকৃত নতুন প্রযুক্তি, তাই বর্তমান ফোনগুলোতে এটি তেমন পাওয়া যায় না। যদিও কিছু ফ্ল্যাগশিপ ফোনকে ই-সিম ধারণে সক্ষম করে তৈরি করা হয়েছে, কিন্তু এই প্রযুক্তি বৃহৎ পরিসরে ব্যবহৃত হতে এখনও কয়েক বছর বাকি। ই-সিম সহ কিছু ফোন হল:
অ্যাপল:
- আইফোন এক্সআর
- আইফোন এক্সএস
- আইফোন এক্সএস ম্যাক্স
- আইফোন ১১
- আইফোন ১১ প্রো
- আইফোন এসই ২ (২০২০)
- আইফোন ১২
- আইফোন ১২ মিনি
- আইফোন ১২ প্রো
- আইফোন ১২ প্রো ম্যাক্স
- আইফোন ১৩
- আইফোন ১৩ মিনি
- আইফোন ১৩ প্রো
- আইফোন ১৩ প্রো ম্যাক্স
- আইফোন এসই ৩ (২০২২)
গুগল:
- গুগল পিক্সেল ৩এ এক্সএল
- গুগল পিক্সেল ৪
- গুগল পিক্সেল ৪এ
- গুগল পিক্সেল ৪এ ৫জি
- গুগল পিক্সেল ৪ এক্সএল
- গুগল পিক্সেল ৫
- গুগল পিক্সেল ৫এ
- গুগল পিক্সেল ৬
- গুগল পিক্সেল ৬এ
- গুগল পিক্সেল ৬ প্রো
স্যামসাং:
- স্যামসাং গ্যালাক্সি এস২০
- স্যামসাং গ্যালাক্সি এস২০+
- স্যামসাং গ্যালাক্সি এস২০ আলট্রা
- স্যামসাং গ্যালাক্সি এস২১
- স্যামসাং গ্যালাক্সি এস২১+ ৫জি
- স্যামসাং গ্যালাক্সি এস২১+ আল্ট্রা ৫জি
- স্যামসাং গ্যালাক্সি এস২২
- স্যামসাং গ্যালাক্সি এস২২+
- স্যামসাং গ্যালাক্সি এস২২ আল্ট্রা
- স্যামসাং গ্যালাক্সি নোট ২০
- স্যামসাং গ্যালাক্সি নোট ২০ আলট্রা ৫জি
- স্যামসাং গ্যালাক্সি ফোল্ড
- স্যামসাং গ্যালাক্সি ফোল্ড ৩
- স্যামসাং গ্যালাক্সি জেড ফোল্ড ২ ৫জি
- স্যামসাং গ্যালাক্সি জেড ফোল্ড ৩ ৫জি
- স্যামসাং গ্যালাক্সি জেড ফ্লিপ ৩ ৫জি
- স্যামসাং গ্যালাক্সি জেড ফ্লিপ ৩ ৫জি ফোল্ড
- স্যামসাং গ্যালাক্সি জেড ফ্লিপ ৪
এছাড়া সনি, হুয়াওয়েই, অপ্পো এবং মটোরোলা এর কয়েকটি ফোন ই-সিম সাপোর্ট করে।