খোয়াবনামা
যুদ্ধবিদ্ধস্ত এই বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এক গ্রাম, অমরকোঠা। হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলটিতে লোকজন গোঁড়ামি আর কুসংস্কারকেই যেন দেবতাজ্ঞানে পূজা করে চলছে যুগের পর যুগ। মুখার্জি পরিবারের সন্তান দাশুর জন্মের ৭ বছরের মাথায়ই বিধবা মা জানতে পারেন, ছেলের প্রজনন সমস্যায় ভোগার সম্ভাবনা রয়েছে। বয়স মোটামুটি হয়ে গেলেই বিয়ে দিয়ে দেয়াই এর সমাধান, বলেছিলেন শহরের এক নামকরা ডাক্তারকাকু। যথারীতি ছেলে বাইশের চৌকাঠে পা রাখতেই কনে দেখা সেরে ফেললেন বীণাপানি মুখার্জি। দেশজুড়ে তখন বিদ্রোহের আগুন দাবানলের মতোই ছড়িয়ে পড়েছে। গণঅভ্যুত্থানে অংশ নিতে গিয়ে পরিচয় হলো রঙ্গবতীর সাথে, ঢাবির চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী সে। দাশু তখন বাংলায় স্নাতক শেষ করা এক ভবঘুরে তরুণ। মুক্তমনা রঙ্গবতীরও দাশুর বর্ণে-গন্ধে, ছন্দে-গীতিতে হৃদয়ে লাগলো দোলা!
“মা, তোমার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করতে আমায় তুমি জোর করো না!”
“ছেলে আমার মুখে মুখে তর্ক করছে! ননদিনী, এসব দেখবার জন্যেই কি ভগবান আমায় এদ্দিন বাঁচিয়ে রেখেছেন?”
“আর বলো না বউমণি! আজকালকার মেয়ে এ, তার ভূতটি তোমার আদরের ধনের কাঁধেও ভর করেছে বৈকি!”
অতঃপর বিনা আড়ম্বরে অনুযোগ-অসন্তোষেই গাঁটছড়া বাঁধলো দাশু-রঙ্গবতী। রঙ্গর সংস্পর্শে এসে ঘরকুনো দাশুও ডানা মেললো এক নতুন পৃথিবীতে। একদিন-
“হে মানব সন্তান! রক্তের বুদ্বুদ দেখেছো?
কালরাত্রি দেখেছো?
দেখেছো বারুদের ঝলকিত তাণ্ডব?
কেবল একজন নয়, শতকোটি পাণ্ডব?…. “
কবিতা শেষ হয়, কিন্তু প্রতিবাদী প্রতিধ্বনি, তার কি শেষ আছে? বিরাট এক ফানুস ওড়ে ইচ্ছের আকাশজুড়ে, “আমরা এবার বুলেট হবো, গ্রেনেডপিনে নাম লেখাবো!”
তখন অবশ্য একালের ‘সিগারেট আফটার সেক্স’ ছিলোনা, তবে ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে’ প্রাণ বলিদানের জন্য রঙ্গর মতো স্বাধীনচেতা মেয়ে আর দাশুর মতো দেশপাগল ছেলে ঠিকই ছিলো। এ গেরিলা জুটির একের পর এক বুকে কাঁপন তোলা আক্রমণে যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ছিলো পাকসেনারা। উত্তরের গ্রামেগঞ্জে আতঙ্কের আরেক নাম রঙ্গ-দাশু। কিন্তু সেবার আর দানবের থাবার নিচ থেকে পালাতে পারেনি রঙ্গবতী। ঈশ্বরের লীলা হয়ে গর্ভে উপ্ত হল হানাদারের বীজ। স্বাধীনতা এলো বিষাদ সিন্ধুর অভিশাপ হয়ে, মুখার্জি পরিবারে অশনি সংকেত বাজিয়ে।
“বউ তুমি পোয়াতি!” – বিস্ময় ঝরে পড়ে বীণাপানির কণ্ঠে।
“শুধু তাই নয়কো বউমণি, হায়েনাগুলির সাথে কেচ্ছাকাহিনী ঘটিয়ে তবে এই বাচ্চা পেটে এসেছে গো!”
ফোঁড়ন কাটা পিসিমণির কথায় তাল দেয় রাজনকাকুও,
“এ বংশে পাপ ঢুকেছে, ঘোর পাপ!”
গ্রামের পুরনো মন্দিরটায় পুজো দিতে গেলে সেখানেও বাঁকা কথা শুনিয়ে দিলেন পুরোহিত।
“মা জননী! তুমি তো শিবের মাথায় জল ঢালতে পারবে না, প্রসাদ তো দূরের কথা।”
“মা, আপনার পেটের ব্যামোর বড়িটা, খাওয়ার পরের… “
“খবরদার! বলে দিচ্ছি, তুমি আমায় ছুঁয়ে দিলে আমি কিন্তু জল স্পর্শ করবো না।”
কাল বিকেল থেকে রঙ্গকে পাওয়া যাচ্ছে না, দাশুর মাথা খারাপ হবার যোগাড়! বীণাপানি মুখ বেঁকিয়ে বললেন, “গিয়েছে দেখো কোথাও আবার… “
সন্ধ্যার আগমুহূর্তে বিষে নীল হওয়া রঙ্গবতীকে তেঁতুলতলায় পাওয়া গেলো, ততক্ষণে অবশ্য অঘটন ঘটে গেছে।
শবদাহের আগেকার রীতিনীতি পালন হবে কি, সিঁথিতে সিঁদুর বা আলতাটুকুও দেবে না প্রতিবেশীরা।
চিতার আগুনে আত্মবিসর্জন দেয়ার পাগলামি চেপে বসেছে তখন দাশুর মাথায়।
“আর কেউ মন্দকথা শোনাবে না তোকে, রঙ্গ! আমি সবাইকে আচ্ছা করে বকে দিয়ে তবেই আসছি, তোকে আর একা থাকতে হবে না।”
নদীতীরে হাঁসগুলো অবাক বিস্ময়ে দেখছে, এ যে সতীদাহ নয়, পতি দাহ!
সূর্যের সোনালি আভায় বিদায়ের ঘণ্টাধ্বনির রেশ, অগ্নিদেবকে সাক্ষী রেখে মুখাগ্নির প্রলয়কুণ্ডে নিজেকে সঁপে দিলো আমাদের দাশু, লোকে যদি বউ পাগলা নাম দেয়, তবে দিক, ভালোবাসায়ও পাপ আছে, নইলে কি আর এমন মরণ হয়!
অভিশপ্ত সাঁঝের মায়ায় আর্তনাদ টের পায় তেঁতুল গাছটার মগডালে বসা ইষ্টিকুটুমটা।
“দাশু, বাবা আমার! এ কি সর্বনাশ করলি নিজের?… “
আতশ কাঁচের নিচে আমরা কেবল মানুষের অবয়বটাই দেখি, তার ক্ষতবিক্ষত হৃদয়টা দেখি না।
আমাদেরই ভুল, আমরা দাশুকে মানুষ ভেবেছিলাম, রক্ত-মাংসের মানুষ!
ডিসেম্বরের সন্ধ্যালগ্নে স্নিগ্ধ বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা পাগলা দাশুর আত্মা আজও বিড়বিড় করে, “ভয় পাসনে রঙ্গবতী!” ধর্ষিতা অর্ধাঙ্গিনীকে মৃত্যুর দেয়ালের ওপাশে দেখানো চাঁদের খোয়াবনামা তো আর মিথ্যে হতে পারে না!
“এবার বুঝি এলো তোমার বিসর্জনের পালা,
যতই সাজাই নয়নতারায় তোমায় পুজোর ডালা!”
Visit our Instagram and Facebook.
Follow The Interlude for more.